বাসার আদুরে পুঁচকেটার মতোই মায়ের কোলে উঠে বাবার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিতো।
একদিন হলো কী?
পুচ্চিটা অসুখে পড়লো।
অসুখে পড়ে সেরে উঠতে পারলো না।
পড়েই রইলেন।
এতে দুশ্চিন্তা বাড়ে পরিবারের।
সেই অসুখ থেকে একদিন উঠলেন।
তবে হারিয়ে ফেললেন চোখ আর কান।
তিনি দেখতে পান না বাবার কেনা খেলনাটা।
বাতাসে কান পেতে শোনেন না মায়ের আদুরে ডাক।
শুরু হয় নতুন পথ চলা।
তবে হাল ছাড়েননি মা-বাবা।
মেয়েকে নতুন করে আলো দেখাতে চান তারা।
অন্ধ হেলেনকে কোলে চেপে রাজ্যের ডাক্তারের চেম্বারে হাজির হন।
একদিন ছুটে যান অন্যরকম এক ডাক্তারের কাছে।
তাকে অনেকেই চেনেন।
তবে ডাক্তার নয়; বিজ্ঞানী হিসেবে।
ওই যে, টেলিফোন আবিষ্কার করে পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন যিনি; তার কথা বলছি আর কী!
সেই বিজ্ঞানী ডাক্তার আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে পুচ্চির মা-বাবাকে আশার কথা শোনালেন।
বললেন, মেয়েটা তো আস্ত একটা ম্যাজিশিয়ান।
অসম্ভব বুদ্ধি তার।
এই বুদ্ধি দিয়ে সে দুনিয়া কাঁপিয়ে দেবে!
একে হেলাফেলা করা যাবে না।
খবরদার!
এমন কথা শুনে বৃষ্টির ফোটার মতো হেলেনের মায়ের চোখ বেয়ে টপাটপ পানি ঝরলো।
বাবার চোখও ভিজলো।
তারা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন।
বাসায় হেলেনের জন্য গৃহশিক্ষিকা নিয়োগ দেওয়া হলো।
তিনি নিজেও একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী।
নাম এনি সুলিভান।
শুরুতে মিস আঙুল দিয়ে হেলেনের হাতে বিভিন্ন চিহ্ন এঁকে শেখানো শুরু করেন।
এতে করে ৮ বছর বয়সেই হেলেন হাতের আঙুলে দাগ কেটে কেটে লেখা শিখে যান।
শুধু তাই নয়; তিনি ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাসহ শুদ্ধ বাক্য উচ্চারণও শিখে নেন।
এতে তাকে নিয়ে কটুক্তি করা মানুষের মুখে তালা লেগে যায়।
আশপাশের মানুষরা চোখ বড় করে তার লেখার দিকে তাকিয়ে থাকে।
গাধার কানের মতো কান বাড়িয়ে তার উচ্চারণ শুনে মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠে।
এই করতে করতে হেলেন পৌঁছে যান ১৪ বছর বয়সে।
ভর্তি হন আমেরিকার নিউইয়র্কের ‘রাইট হুমাসন’ নামক এক স্কুলে। সেখানে বিশ্বখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েনের দেখা পান।
১৯০৪ সালে রাডক্লিফ কলেজ থেকে মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন।
তবে এই ডিগ্রি অর্জনের আগেই তার আত্মজীবনী বই ‘দ্য স্টোরি অব মাই লাইফ’ প্রকাশিত হয়ে যায়।
এরপর তিনি আরও বই লেখেন।
তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ১২।
এ ছাড়া তিনি বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জীবনের বিষাদের ওপর ‘ডেলিভারেন্স’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
চলচ্চিত্রে নিজের ভূমিকায় তিনি নিজেই অভিনয় করেন।
১৯১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের জন্য জাতীয় লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়।
এতে করে হেলেনের পড়ার সুযোগ আরও বেড়ে যায়।
তিনি বাদ্যযন্ত্রের ওপর হাত রেখেই বলতে পারতেন, তাতে কি ধরনের সুর বাজছে।
গায়ক-গায়িকার কণ্ঠে হাত দিয়ে অনায়াসে বলতে পারতেন কি সঙ্গীত গাইছে।
তিনি বহুদিনের পুরনো মানুষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তার পরিচয় বলে দিতে পারতেন।
তিনি ১৯১৫ সালে জর্জ কেসলারকে সঙ্গে নিয়ে হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে তোলেন।
সেই সংস্থাটি এখনও বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েও নদীতে সাঁতার কাটা ও নৌকা বাইতে পারতেন, দাবাও খেলতে পারতেন।
ঘরে বসে নকশি কাঁথা সেলাইসহ আরও কত কি করতে পারতেন!
১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তিনি বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশ্বব্যাপী এক আন্দোলন গড়ে তোলেন।
এর ফলে তিনি ১৯৫৯ সালে জাতিসংঘের বিশেষ সম্মানে ভূষিত হন।
দুনিয়াব্যাপী আলোচনার ঝড় তোলা আলোকিত হেলেন পৃথিবীর প্রথম আলো গায়ে মাখেন ১৮৮০ সালের ২৭ জুন।
তার জন্মস্থান ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা প্রদেশে।
তার বাবার নাম আর্থার কেলার; মায়ের নাম ক্যাথরিন।
বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীকতা জয়ী আলোমাখা এই হেলেন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে তারাদের দেশে চলে যান ১৯৬৮ সালে।